১০ নভেম্বরের সকালটা ছিল অন্যসব দিনের মতোই। রোদ উঠছিল, মানুষ কাজে বের হচ্ছিল, দোকানপাট খুলছিল। কিন্তু পাবনার বাতাসে যেন অদৃশ্য এক শোকের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। শহরের রাস্তাগুলোতে হঠাৎ কেউ না কেউ থেমে বলছিল—
“আজ বকুল ভাইয়ের মৃত্যুদিন…”
এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যেত চারপাশ।
পাবনার সেই মানুষটি, যার নাম উচ্চারণ করলে এক অদ্ভুত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছড়িয়ে পড়ত মানুষের চোখে—বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল।
একজন নেতার চেয়ে বেশি—একজন আপন মানুষ
লাল-সবুজ পতাকা বুকে নিয়ে ১৯৭১-এর যুদ্ধক্ষেত্রে যে তরুণ এগিয়ে গিয়েছিলেন,
সে শুধু দেশের জন্য লড়েননি—
ফিরে এসে আজীবন মানুষের অধিকারের জন্য লড়েছেন।
গরিব কৃষকের জমি নিয়ে অন্যায় হলে তিনি ছুটে যেতেন;
কোনো ছাত্রের পড়ার খরচ না থাকলে লজ্জাহীন হাসিতে বলতেন,
“লেখাপড়া করো, খরচ আমি দেখছি।”
বৃদ্ধ মায়ের চোখের পানি তিনি নিজের হাতের রুমালে মুছে দিতেন।
শীতের সকালে কম্বল বিতরণের সময় তিনি কখনো অন্যদের হাতে দেননি,
নিজেই মানুষের গায়ে জড়িয়ে দিতেন কম্বলটি।
মানুষ তাকে ডাকত—“বকুল ভাই”।
এ নামের সাথে কোনো পদবী যুক্ত থাকত না।
কারণ এই নামেই ছিল সম্মান, আস্থা আর সীমাহীন ভালোবাসা।
মর্মান্তিক এক রাত…
২০০০ সালের দিনটি ছিল পবিত্র শবে বরাত।
মানুষ ইবাদতে ব্যস্ত, ঘরগুলোতে আলো জ্বলছিল।
কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে এলো এক হৃদয়বিদারক সংবাদ—
সড়ক দুর্ঘটনায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন আমাদের বকুল ভাই।
সেদিন পাবনার আকাশ নীরব ছিল,
গভীর রাতে যেন বাতাসও কেঁদেছিল।
যে মানুষটির পদচারণায় মানুষের ঘর ভরে উঠত আশায়,
তার জানাজায় পাবনার মাটিতে জায়গা কম পড়ে গিয়েছিল।
অসংখ্য মানুষ ভেঙে পড়েছিল বুক চাপড়ে…
মায়েরা কেঁদে বলেছিল—
“আমাদের আর কেউ খোঁজ নেবেনা, মা।”
২৫ বছর পরেও কেন মানুষ ভুলে না তাকে?
একটা মানুষ মারা গেলে নামটা ধীরে ধীরে স্মৃতি থেকে মুছে যায়—
কিন্তু বকুল ভাইয়ের নাম মানুষের হৃদয় থেকে মুছেনি, বরং আরো গভীর হয়েছে।
কারণ তিনি পদমর্যাদার নেতা ছিলেন না,
তিনি হৃদয়ের নেতা ছিলেন।
কারো দরকারে তার কাছে যেতে হতো না—
তিনি নিজেই মানুষের দরজায় যেতেন।
কোনো ক্ষমতার অহংকার তাকে ছুঁতে পারেনি।
তিনি ছিলেন সরল, বিনয়ী, মানবিক, মানুষকেন্দ্রিক।
পাবনার রাস্তায় আজও যখন কেউ তার নাম নেয়,
চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে—
কারণ এমন মানুষ ঘরে ঘরে জন্মায় না।
প্রার্থনার হাত আজও ওঠে তার জন্য
২৫ বছর…
সময় অনেক বদলে গেছে, প্রজন্ম বদলেছে, রাজনীতি বদলেছে।
কিন্তু আজও এক জায়গায় মানুষ এক—
বকুল ভাইয়ের জন্য দোয়া করতে তারা ভুলে না।
“হে প্রভু,
এই মানুষটির অপূর্ণতা ক্ষমা করুন,
তার মানবসেবার বদলে জান্নাতে উঁচু মর্যাদা দিন…”
এ দোয়া আজও পাবনার কণ্ঠে কণ্ঠে ওঠে।
শেষ কথা
বকুল ভাই ছিলেন এমন এক সুবাস, যা ঝরে গেলেও রেখে গেছে গন্ধ।
তার আদর্শ, তার ভালোবাসা, তার আত্মত্যাগ—
আজও পাবনার মানুষের পথে আলো হয়ে জ্বলে।
তিনি ছিলেন নেতা নন—
তিনি ছিলেন ভালোবাসা নামের এক আশ্রয়।

বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ১১ নভেম্বর ২০২৫

আপনার মতামত লিখুন