ক্রাইম রিপোর্টার, ইয়াকুব আলী,চাঁপাইনবাবগঞ্জ ||
বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের ভোলাহাট জোনাল অফিস যেন দুর্নীতির আখড়া! ক্ষয়িষ্ণু রেশম চাষকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির কবলে উদ্দিষ্ট-লক্ষ্য ভেস্তে গেছে। সরকারী অনুদানে রেশম চাষীদের পলুঘর নির্মাণ, তুঁতচারা রোপণ, প্রশিক্ষণ প্রদান ও অন্যান্য উপকরণ বিতরণে অনিয়ম, ফাঁকিবাজি আর ভাগ-বাটোয়ারার কারণে শুধুই অর্থ অপচয় হয়েছে- উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এছাড়া রেশমগুটি, রেশম সূতা ও রেশমজাত পণ্যের বাজার না থাকায় রেশম চাষ' কথিত উন্নয়নের চোরাবালিতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে, এমন অভিযোগ করেছেন প্রকৃত রেশম চাষীরা।সংশ্লিষ্ট সূত্র গুলো জানিয়েছে, রেশম চাষের উন্নয়ন ও এই কৃষিজাত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার রেশম চাষী বসনী'দের এক- এক জন'কে এক বিঘা জমিতে তুঁত চারা (তুঁত মূড়া) রোপণের জন্য ২৫ হাজার টাকা, পলু ঘর নির্মাণের জন্য ১ লক্ষ টাকা এবং ৬০ হাজার টাকা মূল্যের পলু পালনের উপকরণ ডালা, চন্দ্রকী, ঘরাশলা ও ৩২টি নেট অনুদান প্রদান করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে। এছাড়া প্রত্যেক বসনী'কে ২৬ দিনের প্রশিক্ষণ বাবদ ১৩ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও পলুপোকার ডিম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। সব কিছুই সরকারী ভাবে দেয়া হয়, শুধু শ্রম দেয় বসনীরা।ধরমপুর গ্রামের বসনী তোফাজ্জল হোসেন জানান, যাদের নিজস্ব জমি নেই তারা অপরের ১ বিঘা জমি অন্তত ১০ বছরের জন্য লীজ গ্রহণ করলে তুঁত মূড়া রোপণ বাবদ ২৫ হাজার টাকা ও পলুঘর নির্মাণ বাবদ ১ লক্ষ টাকা একজন বসনী অনুদান পাবেন। এছাড়া প্রায় ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ডালা, চন্দ্রকী, ঘরাশলা ও ৩২টি নেট পাবেন, আর প্রশিক্ষণ বাবদ পাবেন ২৬ দিনে ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু ৩'শ টাকার নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে তুঁত মূড়া রোপণের জন্য একবিঘা জমির ভূয়া ডিড তৈরি করে যোগসাজশী ভাবে জমি তৈরির জন্য ২৫ হাজার টাকা ও পলুঘর নির্মাণের জন্য ১ লক্ষ টাকা সরকারী কোষাগার থেকে উঠিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয় আর নির্মাণকৃত ঘর অপরিকল্পিত ভাবে দুর্বল করে তৈরি করা হয়। এমনকি ধরমপুর গ্রামের আসিরুদ্দিনের ছেলে সাইদকে পুরাতন পলুঘর দেখিয়েই ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়। ইমামনগর গ্রামের বাসেদ আলী জানান, তাঁকে ঘর নির্মাণ বাবদ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ৩০ হাজার টাকা অফিসের লোকেরা নিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি জমি থেকে তুঁতমূড়া মেরে দিয়েছেন। একই গ্রামের সাজেদ আলী পলু পালন করেন না, অথচ ভোলাহাট জোনাল অফিসের অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল এই ব্যক্তিকে (মনিরুলের শ্বশুর) পলুঘর নির্মাণ বাবদ অনুদান সহ প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান করেছেন। পলু পালন করেন না, এমন ব্যক্তিকে অনুদান দেয়ার অভিযোগ অনেক ।পলুঘর নির্মাণের টাকা মোবাইল নম্বরে চার কিস্তিতে বিতরণ করা হয়। পলুঘর নির্মাণ বাবদ ৭০ হাজার টাকা বসনীকে দিয়ে ৩০ হাজার টাকা এডি, রেশম বোর্ডের সদস্য সমিরুদ্দিন, অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ও বসনী সমিতির সেক্রেটারী সেকামউদ্দিন গং ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। সমস্ত কিছু অনুদান ও প্রশিক্ষণ পাওয়া হয়ে গেলে রেশমচাষ বন্ধ করে দিচ্ছেন সুবিধাভোগীরা। চরধরমপুর গ্রামের ইমাম হোসেন মাষ্টারের চার ছেলে সাইফুল্লাহ্, সফিউল্লাহ, আমানুল্লাহ ও ওলিউল্লাহ ৪টি ঘর সহ সকল সুবিধা'দি নিয়ে জমি থেকে তুঁত মূড়া উপড়ে ফেলে পলুপালন বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে ২৭০ জন বসনী এই অনুদান প্রকল্পের আওতায় সুবিধা ভোগ করছেন। এর আগে ১২ হাজার বসনী (রেশমচাষী) ভোলাহাট উপজেলায় রেশম চাষ করতেন।বছরে পাঁচ বার পলু পালন করা হয়।পলুপোকার খাদ্য তুঁত পাতা। নিয়ম অনুযায়ী একবিঘা জমিতে তুঁত চারা রোপণের জন্য ২৫ হাজার টাকা অনুদান পাবেন বসনীরা। কিন্তু তিন কাঠা, পাঁচ কাঠা বা সাত/দশ কাঠা জমিকে কাগজে এক বিঘা দেখিয়ে ২৫ হাজার টাকা অনুদান আত্মসাৎ করা হয়। আর ১ বিঘা তুঁত জমি ও ১ খোপ (১ ঘরা=১৬ ডালা) পলু পালনের বিপরীতে ১টি পলুঘর নির্মাণের জন্য একজন বসনী ১ লক্ষ টাকা ও অন্যান্য উপকরণ পাওয়ার যোগ্য। সব রকমের অনুদান পাওয়া হয়ে গেলে পলুপোকার ডিম (বীজ) রেশম বীজাগার হতে গ্রহণ করার পর বাড়িতে নিয়ে এসে পলুপালন (রেশমচাষ) না করে বীজগুলো ফেলে দেয় সুবিধাভোগীরা। এমনকি অনুদানের টাকায় পলুঘর নির্মাণ না করে এটাচ বাথরুম সহ শয়নকক্ষ ও গোয়ালঘর নির্মাণ করেছেন কতক বসনী! তা সরেজমিনে গোহালবাড়ি গ্রামের ফারহানা খাতুনের পলুঘর কোড-২৪৬ তে প্রত্যক্ষ করা গেছে।প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কোটি কোটি টাকা অনুদান বিতরণ করছেন বটে, কিন্তু এডি তরিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (বসনী প্রতিনিধি) সমিরুদ্দিন, অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ও বসনী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেকামউদ্দিন গং সিন্ডিকেট বিভিন্ন কৌশলে সরকারী অনুদান আত্মসাৎ করছেন। ফলে রেশমের উন্নয়ন ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এসে ঠেকেছে। ধরমপুর গ্রামে ১৪ জন বসনী ছিল, এখন মাত্র ৪ জন বসনী টিকে আছেন। গোহালবাড়ী গ্রামেও ১৪ জন বসনী ছিল, এখন টিকে আছেন ২ জন। তারাও রেশম চাষ বন্ধ করে দিবেন বলে জানা গেছে। অথচ সকলেই অনুদান ভোগ করেছেন। পলুপালন না করে অনেক বসনী তুঁত জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছেন। স্বয়ং রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (বসনী প্রতিনিধি) সমিরুদ্দিন তুঁত জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছেন। প্রত্যেক বসনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না! কাউকে অনেকবার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে অর্ধেক প্রশিক্ষণ ভাতার বিনিময়ে। প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই ঐ অর্ধেক টাকা হাতিয়ে নেন কর্তারা। পলুপালনের সাথে জড়িত নন এমন নারী-পুরুষকেও দুর্নীতির আশ্রয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে! অথচ প্রশিক্ষণ না পাওয়ার অভিমানে ধরমপুর গ্রামের আওয়াল পলুপালন বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ পাননি এমন অভিযোগ অনেক।বসনীদের জানান, বীজাণু মুক্ত ও উন্নত জাতের পলুপোকার ডিম সরবরাহ করা হচ্ছে না। প্রায়শই পলুপোকা গুলো নষ্ট হয় এবং বসনীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর পেছনেও কর্তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলে বসনী'দের দাবী। আরো বলেন, চীন ও ভারতে যখন উন্নত জাতের পলু' (রেশম পোকা বা রেশম মথ) পালন করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে পুরনো জাতের পলু'র চাষ রয়ে গেছে। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণাগার থাকলেও কার্যত কোন সুফল পাচ্ছেন না বসনীরা। ফলে রেশমগুটির মান ও ফলন খুবই কম।ঝাউবোনা গ্রামের রেশমগুটি ক্রেতা ও সূতা উৎপাদনকারী মোঃ জামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, বর্তমানে যে ৩৭০ জন বসনী রয়েছেন তারা রেশম বীজাগার থেকে বীজ নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সবাই পলু পালন করছেন না! বাড়ি নিয়ে বীজগুলো নষ্ট করে ফেলছেন। কারণ সকলের নিকট থেকে গুটি পাওয়া যাচ্ছে না। রেশম সূতা তৈরির জন্য রিলিং মেসিন বা কাট-ঘাই চালু করতে গেলে একজন ব্যবসায়ীর অন্তত ১০০ মণ গুটির প্রয়োজন। তাহলে কোন-রকমে টিকে থাকা যাবে। তিনি আরও জানান, গুটির মূল্যও কম। তিনি দাবী করেন, যদি রেশম উন্নয়ন বোর্ড গুটির মূল্য ৩০ হাজার টাকা মণ ধার্য করে এবং ক্রয় করে তাহলে বসনী'মহল বেঁচে থাকতে পারবে! আরও বলেন, রেশম সূতা ও রেশমী পণ্যের বাজার না থাকায় দেশীয় রেশম শিল্প মার-খাচ্ছে। এ জন্য ভারত, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাজিকিস্তান থেকে রেশম সূতা ও রেশমজাত পণ্য-দ্রব্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশি রেশমজাত পণ্যের বাজার না থাকায় ব্যবসায় লস হওয়ার কারণে ভোলাহাটের সাড়ে ৪ শ' জন রেশম সূতা ব্যবসায়ীর সূতা তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে । বর্তমানে একটি কারখানা চালু রাখার মত গুটি উৎপাদিত হচ্ছে না। উন্নয়নের নামে এমন শুভঙ্করের ফাঁকি চলতে থাকলে রেশমের অবস্থা লাটে উঠে যাবে, এমনটাই আশঙ্কা করছেন বসনীমহল ও রেশম ব্যবসায়ীরা!সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেশম শিল্পকে বাঁচাতে হলে, প্রথম'ত: দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়'ত: যারা পলুপালনের চুক্তিতে অনুদান ভোগ করার পর পলুপালন বন্ধ করেছেন তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরতের জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়'ত: প্রকৃত রেশমচাষীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থ'ত: দুর্নীতির উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। পঞ্চম'ত: রেশমগুটির মূল্য যুগোপযোগী নির্ধারণ করতে হবে। ষষ্ঠ'ত উচ্চ জাতের পলুপোকার ডিম বা বীজ সরবরাহ করতে হবে। সপ্তম'ত: দেশী রেশমজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশে আমদানীকৃত বিদেশী রেশমজাত পণ্যের অবাধ আমদানী নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবেই রেশমচাষী, রেশমসূতা উৎপাদনকারী, রেশমীবস্ত্র তৈরিকারক তাঁতী ও ব্যবসায়ীরা অনেকাংশে বেঁচে থাকার মত আশার আলো দেখতে পাবে। এ ব্যাপারে দেশের ক্ষয়িষ্ণু কৃষিজ শিল্পকে বাঁচাতে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে মনোযোগী হওয়া উচিত! ভোলাহাটে রেশমের সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য সহকারী পরিচালক মোঃ তরিকুল ইসলামের নিকট ধর্না দিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। গড়িমসি ও তালবাহানা করেছেন! তিনি ভোলাহাট জোনাল অফিসে- অফিস করেন না। তিনি থাকেন বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড, রাজশাহীর প্রধান কার্যালয়ে। কতক সময়ে তিনি ছুটির দিনে গোপনে ভোলাহাটে আসেন আর কার্যাদী সেরে চুপিসারে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। তাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায়নি! (সরেজমিন প্রতিবেদন, পর্ব-১)